“যদিদং”

“যদিদং”
নাটক, নির্দেশনা: সোহন বন্দোপাধ্যায়
প্রযোজনা: নট-রঙ্গ

ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারলাম স্টার থিয়েটারে জি-বাংলা নাট্য উত্সবের আয়োজন করেছে। । বাছা বাছা কয়েকটি নাটক মঞ্চস্থ হবে সেই উত্সবে। অনুষ্ঠানসূচীতে দেখলাম সোহন বন্দোপাধ্যায়ের “যদিদং” নাটকটিও রয়েছে। “যদিদং” নাটকটি সম্পর্কে অনেক শুনেছি, পড়েছি। তাই অনেকদিন ধরেই ইচ্ছে ছিল নাটকটি দেখার। সুতরাং সুযোগ ছাড়লাম না, বারাসাত থেকে গাড়ি নিয়ে যথা সময়ে পৌঁছে গেলাম ঐতিহাসিক স্টার থিয়েটারে। ভয় ছিল টিকিট পাবো কিনা, কারণ শুনেছিলাম নাটকটি খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কিন্তু হলে গিয়ে দেখি সাকুল্যে জনা পঞ্চাশেক দর্শক, তার মধ্যে বেশ কিছু নিমন্ত্রিত। মাত্র চল্লিশ টাকা প্রবেশমূল্য, তাও দর্শক নেই। পরে শুনলাম এই উত্সবের যথেষ্ট প্রচার হয়নি, তাই কলকাতার বেশির ভাগ থিয়েটার প্রেমী দর্শক জানেনই না, এত সুলভে নাটক দেখার সুযোগ করে দিয়েছে জি-বাংলা।

“যদিদং” -কে হয়ত একটি আধুনিক প্রহসন বলা যেতে পারে, সুরিয়ালিস্ট কমেডিও বলা যেতে পারে। বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটিকে যে সময়ে আমরা ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ করে চলেছি, আঘাতের পর আঘাত করে তাকে ধুলিস্যাত করে ফেলতে চাইছি, ঠিক সেই সময়ে দাড়িয়েই সোহনের এই নাটক আমাদের শেখায় যে, বিবাহিত জীবন কেবল মাত্র এক আইনি বন্ধন নয়, সামাজিক রীতি নয়, আরও বেশি কিছু। এমন কিছু, যা ইচ্ছে করলেই ছিড়ে ফেলা যায় না, কোর্টের ডিক্রি অনুসারে ভাগ করা যায় না, কেটে ভাগাভাগি করা যায় না। সেই কিছু-র নাম হয়ত ভালবাসা, হয়ত সমঝোতা, হয়ত সহনশীলতা, কিম্বা হয়ত স্রেফ “মনুর মা”!

আমার এক প্রিয়জন একটা কথা বলতেন, “বিয়ের আগে যে মনোরমা, বিয়ের কিছুদিন বাদেই সে হয়ে যায় মনোর মা!” কিন্তু সেই “মনোর মা” বা “মনুর মা”-রাই যে সংসার টিকিয়ে রাখার প্রধান উপাদান, সেটা আমরা অনেক সময়েই ভুলে যাই। যদিদং নাটকের দুই চরিত্র, এক তরুণ দম্পতি (সোহন বন্দোপাধ্যায় ও মৌসুমী সেনগুপ্ত), সেই কথাটাই ভুলে গিয়েছিল। সাত বছর বিবাহিত জীবন কাটাবার পর তারা স্থির করে আর এই ভাবে থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাদের সমস্থ স্থাবর সম্পত্তি তারা সমান দুই ভাগে ভাগ করে নেয়। চেয়ার টেবিল, আসবাব, ফ্রিজ – সমস্ত কিছুই করাত দিয়ে কেটে দু টুকরো করে ভাগ করে নেয়। ঘরের মধ্যে রেখা টেনে দুজনের জায়গা সমান করে আলাদা করে নেয়। কিন্তু তার পরেও তাদের মনে হয়, কিছু একটা রয়ে যাচ্ছে যা তারা কিছুতেই ভাগ করতে পারছে না। তাই তারা ধরে বেঁধে নিয়ে আসে এক নকল উকিল পঞ্চানন সাঁতরা-কে (দেবসঙ্কর হালদার), যিনি আবার পার্ট টাইম তান্ত্রিক-এর প্রক্সিও দিয়ে থাকেন। কিন্তু পঞ্চানন-বাবুর কাছে এর কোনো আইনি সমাধান বা তান্ত্রিক জড়ি-বুটি নেই। তার কেবল রয়েছে মনুর-মা, যে তার জন্য বিউলি ডাল আর ধনে পাতার বড়া রেঁধে অপেক্ষা করে থাকে। আর শেষ মেষ এই মনুর-মাই পারেন এই যুযুধান দম্পতিকে ফের মিলিয়ে দিতে, যদিও সেই কাজের জন্য তাকে এক বারও মঞ্চে আসতে হয় না।
আজকের আধুনিকা শিক্ষিতা নারী এই নাটক দেখে হয়ত প্রতিবাদ করতে পারেন, ঘরে বসে স্বামীর জন্য বিউলি ডাল আর ধনে পাতার বড়া রাঁধতে রাজি নাও হতে পারেন। কিন্তু এখানেই হবে ভুল, কারণ “মনুর মা” তো কোন রক্ত মাংসের মানুষ নয়, “মনুর মা” একটি abstract concept ! একটা ভাবনা, যা স্বামী স্ত্রী দুজনের মনেই বাস করে, যাকে ভাগ করা যায় না। যদিদং দেখে আমি অন্ততঃ এই টুকুই বুঝেছি। এবং আমার বোঝাটা যদি ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে বলব নাট্যকার নির্দেশক সোহন বন্দোপাধ্যায় সেই কাজে সম্পূর্ণ সার্থক। আর এই কঠিন বিষয় বস্তুকে তিনি পেশ করেছেন অসাধারণ হিউমার-এর মোড়কে।

অভিনয়ে দেবশঙ্কর আবার প্রমান করলেন, তিনি একাই একশ। প্রায় গোটা নাটক টাকে তিনিই বয়ে নিয়ে গেলেন। অবশ্য নাট্যকার তাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। তুলনায় অন্য চরিত্র দুজনের প্রতি হয়ত একটু অবহেলাই করেছেন। তাদের দাম্পত্য সংকটটা খুব একটা জোরালো হয়ে প্রস্ফুটিত হলো না। কেবলই অহং বোধ, ইগো, অথবা আপোষহীনতাই কি কোনো দম্পতিকে বিচ্ছেদের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে পারে? আর কোন কারণ, কোনো অপ্রতিরোধ্য চাপ কি থাকতে পারে না? তাদের একটা গল্পও তো থাকতে পারে?

স্বল্প চরিত্রের নাটক কখনো কখনো নির্দেশককে একটু সমস্যায় ফেলে। স্টেজ কম্পোজিশনে বৈচিত্র আনা অনেক সময় কঠিন হয়ে পরে। যদিদং নাটকে চরিত্র সংখ্যা মাত্র তিন, এবং তারা সব সময় মঞ্চে থাকেন। সমস্যা আরো গভীর হয় যখন গল্পের খাতিরে তারা মঞ্চে কেবল সীমিত অঞ্চলের মধ্যে থাকতে বাধ্য হন। ফলে দীর্ঘ ১০০ মিনিটের নাটকে, মঞ্চের ছবিটা প্রায় একই থেকে যায়, যা দৃশ্যত একটু ক্লান্তিকর ঠেকে বৈকি। সংলাপ, অভিনয়, সঙ্গীত, এ সবই ব্যবহার করা হয়েছে এই বাধা কে অতিক্রম করতে, কিন্তু এতো আর শ্রুতি নাটক নয়। দর্শক তো নাটক “দেখতেই” এসেছেন। মঞ্চ নিয়ে আর একটু ভাবনা চিন্তা করার সুযোগ ছিল। যেমন, কাটা ফ্রিজ, আসবাব, ইত্যাদির ছোট ছোট ছবির মালা না করে, যদি প্রমান সাইজের কাট আউট ব্যবহার করা হত, খুব একটা মন্দ হত না। অভিনেতারা সেগুলি ব্যবহার করে মঞ্চে কিছুটা বৈচিত্র আনতে পারতেন। আর একটা কথা – আধ খানা চেয়ার কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, ঠিক যেমন ভেঙ্গে যাওয়া সংসারে একা স্বামী বা স্ত্রী জীবনের ভার বহন করতে পারে না।

নট-রঙ্গ ও সোহন কে ধন্যবাদ একটি ভালো প্রযোজনা উপহার দেবার জন্য। পরবর্তী প্রযোজনা “মন মানুষের” জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করে রইলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.