প্রতি বছরের মতো, এবছরও ধুম ধাম করে উত্তর আমেরিকা বঙ্গ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো ওর্লান্ডো শহরে। আর প্রতি বছরের মত, বাংলা সংস্কৃতির নানান পসরার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্যও সামান্য একটু মুখ দেখাবার সুযোগ পেয়েছিল। গান, বাজনা, নাটক ইত্যাদি অনুষ্ঠান উপলক্ষে যত খরচ হয়েছে, বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে খরচ করা হয়েছে তার এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র। তবু একেবারে যে হারিয়ে যায়নি, তার জন্য বেশ কিছু অভিবাসী সাহিত্য প্রেমিকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। এবছর, সাহিত্য সভার দায়িত্ব পরেছিল আমার উপর। বাজেট সীমিত, সুতরাং খুব ভাবনা চিন্তা করে এগোতে হয়েছিল। দেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের মধ্যে থেকে আমরা পেয়েছিলাম শ্রীজাত এবং বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়কে। বিনায়ক এসেছিলেন দুকুল পত্রিকার সৌজন্যে। দেশ পত্রিকার সম্পাদক শ্রী হর্ষ দত্ত আসবেন বলেছিলেন, কিন্তু শেষে জানালেন অনিবার্য কারণ বশতঃ তিনি আসতে পারছেন না। তবে আমি ঠিক করেছিলাম দেশের (অর্থাৎ কলকাতার) সাহিত্যিকদের সঙ্গে, আমাদের কিছু অভিবাসী সাহিত্যিককে আমন্ত্রণ জানাব, যাতে দুদিনের অনুষ্ঠান করতে কোন অসুবিধে না হয়।
শনিবার আর রবিবার, দুদিনই সকাল বিকেল ছিল অনুষ্ঠান। শনিবার সকালে ছিল একটি আলোচনা সভা, অংশগ্রহন করেছিলেন, শ্রীজাত, বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়, এবং আমাদের নিজেদের, আলোলিকা মুখোপাধ্যায়। আলোচনার বিষয় ছিল, “আমার কাছে কবিতা/গল্প কিভাবে আসে।” কোনো একটি অনুপ্রেরণা বা সুত্র থেকে একটি কবিতা বা গল্প লেখকের মন থেকে কিভাবে কলমের গোড়ায় নেমে আসে, সেই রহস্যের কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়াই ছিল আমার উদ্দেশ্য। যদিও জানি প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া খুবই কঠিন, কিন্তু নিজেকে প্রশ্ন না করলে তো উত্তর মিলবে না কোনদিনও। তাছাড়া সাধারণ পাঠকের কাছে এটা একটা চিরন্তন কৌতুহল। আমাদের অতিথি সাহিত্যিক দের জন্যই হোক বা, বিষয় বস্তুর আকর্ষণের কারণেই হোক, খুব শীঘ্রই ঘর ভরে গেল উদগ্রীব পাঠক শ্রোতার ভিড়ে। ইতিমধ্যে অনিন্দ চট্টোপাধ্যায় (চন্দ্রবিন্দু), শুভমিতা, অনুপম রায়, ইত্যাদি “সেলিব্রিটি” ঘরে এসে বসতেই, সভা পুরোপুরি জমে গেল। আলোলিকা-দি বললেন, অভিবাসী জীবন থেকেই তিনি খুঁজে পান তার গল্প সাহিত্যের উপাদান। কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে বললেন কিভাবে সেই উপাদান থেকে তিনি নির্মান করেছেন তার গল্প। এরপর তরুণ কবি ও গদ্যকার বিনায়ক বললেন, যদিও তিনি খুব সঠিক ভাবে জানেন না কিভাবে কবিতা তার কাছে আসে, তবে এটুকু জানেন যে কবিতা যখন আসে, তখন আসে এক প্রবল বন্যার মত। সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তাকে রোখা যায় না, লিখে ফেলা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। তুলনায়, গল্প উপন্যাস আসে অনেক সহজে। তবে বিনায়ক যখন বললেন, আজকের সামাজিক রাজনৈতিক পটভূমিকায় দাড়িয়ে সব বিষয় নিয়ে লেখা যায় না, তখন উপস্থিত অনেক পাঠক শ্রোতার ভ্রু কুঞ্চিত হতে লক্ষ্য করলাম। আশংকা করলাম প্রশ্ন উঠবে লেখকের দায়িত্ব প্রসঙ্গে, এবং তা এলো। বিনায়ক অবশ্য বললেন, যে লেখকের অবশ্যই সস্বাধীনতা রয়েছে যে কোন বিষয়ে লেখার, কিন্তু প্রকাশক সম্পাদক সেটা গ্রহণ করবেন কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু আলোচনার মধ্যে থেকে এটুকু স্পষ্ট হয়ে উঠলো, যে আজকের তরুণ লেখক তার সামাজিক এবং রাজনৈতিক গ্রহণ যোগ্যতা বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন। এর পরের বক্তা ছিলেন শ্রীজাত। উনিও বিনায়কের সঙ্গে একমত হয়ে বললেন, কবিতা তার কাছে হঠাতই আসে, আর যখন আসে তখন বাস্তব জগত থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তিনি। বহুবার গাড়ি চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছেন, একবার একটা মৃদু টোকাও খেয়েছেন। তবে শ্রীজাত অকপটে স্বীকার করলেন, কবিতা কিভাবে আসে তার জানা নেই। তবে এটা ঠিক, কি লিখবেন, কিভাবে লিখবেন – তা সবটাই নির্ভর করে তার ইচ্ছার উপর। কবিতার নির্মান বা ক্রাফটিং নিয়ে উনি বেশি ভাবনা চিন্তা করেন না। যে ভাবে কবিতা তার কাছে ধরা দেয়, উনি সেভাবেই তাকে কাগজ-কলমে বন্দী করেন। আলোচনায় অন্যান্য প্রশ্নের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন করলেন অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। বললেন, “দেখা গেছে সম্পাদকের চাপে এবং নির্দিষ্ট সমেয়ের মধ্যে লেখা জমা দেবার তাড়ায়, অনেক সময় অসামান্য কিছু লেখার সৃষ্টি হয়েছে এবং তা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছে। বক্তা লেখকদের সে প্রসঙ্গে মতামত কি?” এবিষয়ে অবশ্য সকলেই মোটামুটি একমত হতে দেখা গেল। সময়ের চাপ, বা ডেডলাইন, গদ্যের ক্ষেত্রে যতটা সামলানো সম্ভব, পদ্যের ক্ষেত্রে নয়। কেউ বললেন, সময়ের চাপ যখন থাকে তখন বেশি ভাবনা চিন্তা করার সময় থাকে না। লেখককে সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হয় তার অবচেতনের উপর। হয়ত সেই কারণেই সময়ের চাপ অনেক ভালো লেখা বার করে নিতে সক্ষম হয়। লেখার অনেক প্রায়োগিক বিষয় নিয়েও আলোচনা হলো, আমি আর সবিস্তারে সে বিষয়ে যাব না। তবে সভা শেষে সকলে বেশ তৃপ্ত মনেই অন্য অনুষ্ঠান দেখতে বেরিয়ে গেলেন।
শনিবার বিকেলে ছিল কবিতা পাঠের আসর। কবিতা পড়লেন, সোমা মুখোপাধ্যায়, রুদ্রশঙ্কর, রাহুল রায়, স্বপ্না রায়, রিমি পতি, ভারতী চৌধুরী, তপতী দাস, তপতী ভট্টাচার্য, এবং অবশ্যই বিনায়ক বন্দোপাধ্যায় ও শ্রীজাত। উপচে পড়া ভিড় দেখে মনে হচ্ছিল, আর একটু বড় ঘর হলে বোধহয় ভালো হত। এক কবিতা প্রেমীর মতে, তার কাছে এই আসরই ছিল বঙ্গ সম্মেলনের শ্রেষ্ঠ অনুষ্ঠান। তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
পরদিন, রবিবার সকালে ছিল আরেকটি আলোচনা সভা বা প্যানেল ডিসকাসন। বিষয় ছিল, “আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রচার ও প্রসার।” বক্তা ছিলেন, ম্যাসাচুসেট্স থেকে রাহুল রায়, নর্থ ক্যারোলিনা থেকে অঞ্জলি ভট্টাচার্য্য, নিউ জার্সি থেকে আলোলিকা মুখোপাধ্যায়, ইংল্যান্ড থেকে ভারতী চৌধুরী, এবং সিনসিনাটি থেকে শর্বরী গুপ্ত। নিউ জার্সি থেকে প্রনয় চ্যাটার্জিরও অংশগ্রহন করার কথা ছিল, কিন্তু বিমান বিভ্রাটের জন্য আর এসে পৌঁছতে পারেননি। বক্তারা সকলেই দীর্ঘ দিন পবাসে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা করে চলেছেন। নিজেরা লেখা লিখি ছাড়াও সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশনা, সাহিত্য চক্র পরিচালনা ইত্যাদি করে চলেছেন। তাদের কাছে আমার প্রশ্ন ছিল, এই প্রবাস জীবনে তারা কোন তাগিদ থেকে বাংলার চর্চা করে চলেছেন, এবং সেই চর্চার ফসলটাই বা কি? বিশ্বের আঙ্গিনায় বাংলা সাহিত্যের অবস্থানটাই বা কোথায়? রাহুল রায় বললেন বোস্টন এবং নিউ-ইয়র্ক অঞ্চলে বাংলা সাহিত্যের চর্চার ইতিহাস। প্রসঙ্গক্রমে নিউ ইয়র্ক অবস্থিত বাংলা সংস্কৃতি সঙ্ঘ-র (বা Cultural Association of Bengal বা CAB) কথা উঠল। সংবাদ বিচিত্রা নামক পাক্ষিক পত্রিকার মাধ্যমে উত্তর আমেরিকার বাঙালির ঘরে ঘরে বাংলার সংবাদ এবং সাহিত্য পৌছে দেবার যে কাজ শুরু করেছিলেন শ্রী রনজিত দত্ত, তা আজও অব্যাহত। রাহুল বললেন যে আজ ম্যাসাচুসেট্স এ বাংলা সাহিত্যের চর্চা এক তুঙ্গে পৌঁছেছে, যার পেছনে রয়েছে একাধিক ব্যক্তির ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। “লেখনি” পাঠচক্র এক অনবদ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। আশাবাদী রাহুল বললেন, উত্তর আমেরিকায় বাংলা ভাষা গৌরবের সঙ্গে বেঁচে রয়েছে এবং থাকবে।
শ্রীমতি আলোলিকা মুখোপাধ্যায়ও CAB’র প্রসঙ্গ তুললেন তার বক্তব্যে। এছাড়া, নিউ জার্সি এবং নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত একাধিক পত্রিকার কথা বললেন, যার মধ্যে রয়েছে অতলান্তিক, সাংবাদিক, উদয়ন, কল্লোল সাহিত্য পত্রিকা, উড়ালপুল, আনন্দ সংবাদ এবং আনন্দলিপি। দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশিত অন্তর্জাল পত্রিকা পরবাস-এর কথাও উল্লেখিত হল। বললেন গায়াত্রি গামার্শ সাহিত্য পুরস্কারের কথা। উত্তর আমেরিকা থেকে বোধহয় এটাই একমাত্র বাংলা সাহিত্যের পুরস্কার। এই পুরস্কার কিন্তু শুধু উত্তর আমেরিকার লেখকদের জন্যই নয়। সারা পৃথিবীর বাংলা সাহিত্যের লেখকরা এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হতে পারেন।
অধ্যাপক কবি শ্রীমতি অঞ্জলি ভট্টাচার্য্য বললেন ওয়াশিংটন ডি সি, এবং নর্থ ক্যারোলিনায় প্রতিষ্ঠিত “গদ্য পদ্যের আসর-এর ” কথা। এই আসরের মাধ্যমে সাহিত্য চর্চা, ভাবনার আদান প্রদান ঘটিয়ে বাংলা সাহিত্যকে এদশে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। কলকাতায় একটি সাখা খোলা হয়েছে। কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন ছাত্র ছাত্রীদের একটি বৃত্তি দেবার ব্যবস্থাও করেছে এই সংস্থা।
শ্রীমতি ভারতী চৌধুরী আমাদের জানালেন ইংল্যান্ডে বাংলা সাহিত্যের হাল হকিকত। জানালেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় গুলি কিভাবে বাংলা ভাষা প্রসারের কাজ করছে। তবে অনার কথা শুনে মনে হলো, ইংল্যান্ডে বাংলা ভাষার উপর বেশির ভাগ কাজ করছেন বাংলাদেশী অভিবাসীরাই।
আমাদের সর্ব শেষ বক্তা ছিলেন, দুকুল পত্রিকার সম্পাদক শর্বরী গুপ্ত। শর্বরী বললেন কেন তিনি এই পত্রিকা প্রকাশ করতে উদ্যোগী হলেন এবং কি কি সমস্যার মোকাবিলা তাকে করতে হয়। বললেন, ভালো লেখা পাওয়া একটা সমস্যা। বললেন, পত্রিকার মান বজায় রাখতে হলে, সব লেখা সব সময় ছাপা সম্ভব হয় না। কিন্তু অনেক অভিবাসী লেখক, তাদের লেখা মনোনীত না হলে ক্ষুব্ধ হন। এছাড়া পাঠক পাওয়া এবং পাঠক তৈরী করা একটি বড় সমস্যা। অর্থনৈতিক সমস্যা তো রয়েছেই। তবু সব কিছু অতিক্রম করে দুকুল এগিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। শ্রোতাদের সঙ্গে আলোচনায় উঠে এলো নানান প্রসঙ্গ। কেউ বললেন বাংলা ভাষা প্রসারের জন্য অভিবাসী বাংলাদেশীরা যতটা তৎপর, পশ্চিম বঙ্গের বাঙালিরা ততটা নন। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম বাংলা ভাষার ব্যবহারে অনেক বেশি স্বচ্ছল এবং সাবলীল। তুলনায়, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি (দ্বিতীয়) প্রজন্মের সন্তানেরা ছোটবেলায় একটু আধটু বাংলা বললেও, পরে তা ভুলে যান। তাদের বাবা মাও সে বিষয়ে উদাসীন। উত্তরে একজন জানালেন যে পশ্চিম বঙ্গের বাঙালি প্রথমে ভারতীয়, তারপর বাঙালি। সুতরাং বাংলার প্রতি তার দায়বদ্ধতা তেমন জোরালো নয়। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বঙ্গ সাহিত্য পৌঁছে দেবার জন্য আরেকটি প্রস্তাব এলো। বাংলা হরফের বদলে যদি ইংরাজি বা রোমান হরফে আমরা বাংলা লিখি, তাহলে হয়ত অনেকেই তা পড়তে পারবে এবং বুঝতে পারবে। কম্পিউটার, ইন্টারনেট এবং স্মার্ট ফোনের যুগে আমরা প্রায়শই এই ভাবে বাংলায় আমদের মনের কথা প্রকাশ করি। অভ্র বা গুগল ব্যবহার করে আমরা এভাবেই লিখি। যেহেতু আমদের পরবর্তী প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা বাংলা বুঝতে সক্ষম, কেবল বাংলা হরফ পড়তে তাদের বেশি সমস্যা, সুতরাং এভাবে তাদের কাছে বাংলা ভাষা পৌঁছে দেওয়া হয়ত কিছুটা সহজ হবে। পৃথিবীর অনেক ভাষাই রোমান হরফ ব্যবহার করে। সুতরাং বাংলা ভাষায় ব্যবহার করলে অসুবিধেটা কোথায়? অন্যান্য আরও অনেক বিষয়েই আলোচনা হলো, কিন্তু সল্প পরিসরে সব কিছু লেখা সম্ভব নয়। কিন্তু সভা শেষে এটা পরিস্কার বোঝা গেল, বাংলা ভাষা ফুরিয়ে যায়নি, সহজে যাবেও না।
রবিবার বিকেলের শেষ অনুষ্ঠান ছিল অনু গল্পের আসর। শর্ত ছিল, পাঁচ মিনিট বা তার কম সময়ে স্বরচিত গল্প পাঠ করতে হবে। গল্প পড়লেন রাহুল রায়, স্বপ্না রায়, আলোলিকা মুখোপাধ্যায়, কৌশিক সেন, তপতী ভট্টাচার্য্য, নিলয় মুখার্জি, জয়ন্তী বন্দোপাধ্যায়, কিষান লাল চক্রবর্তী। আমারও সুযোগ হয়েছিল দুটি গল্প শোনাবার। শেষে বিনায়ক বন্দোপাধ্যায় শোনালেন একটি গল্প। গল্পটি তিনি লিখে আনেননি। আগের দিন সন্ধ্যাবেলায় মূল প্রেক্ষাগৃহে ঘটে যাওয়া একটি ছোট্ট ঘটনাকে (যার সাক্ষী আমিও ছিলাম) কেন্দ্র করে একটি চমত্কার গল্প শোনালেন তিনি। আমাদের প্রথম অধিবেশনের মূল প্রশ্নের উত্তর একটি জলজ্যান্ত উদাহরণের মাধ্যমে দিয়ে গেলেন প্রতিভাধর লেখক বিনায়ক।
অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে বঙ্গ সম্মেলনে প্রকাশিত স্মরণ পত্রিকাটির আনুষ্ঠানিক উন্মোচন করলেন বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়। পত্রিকাটি সম্পাদনা করেছেন আলোলিকা মুখোপাধ্যায়। দেশ বিদেশের বিশিষ্ট লেখকদের লেখায় সমৃদ্ধ কাগজটি পাঠকদের সমাদর পাবে বলে মনে করি।
চৌতিরিশতম উত্তর আমেরিকা বঙ্গ-সম্মেলনের অন্যান্য অনুষ্ঠান কেমন হয়েছে জানিনা, তবে যারা সাহিত্য অধিবেশনে এসেছিলেন, তারা যে আনন্দ পেয়েছেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আশা রাখি, আগামী বছর গুলিতে বঙ্গ সম্মেলনের উদ্যোক্তারা বাংলা সাহিত্য সভার ব্যাপারে আরও একটু যত্নশীল হবেন এবং বিনিয়োগের অঙ্কটা আর একটু বাড়াবেন।
সুদীপ্ত,
আপনাকে একজন সুধীজন বলেই গন্য করি এবং বন্ধু বলেই ভেবে থাকি। আপনি সম্পূর্ণ নিজস্ব ভালবাসায় এই ব্লগ দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ করে আসছেন। আপনাকে সাধু জানাই। এবং সেই কারণেই আপনার এই লেখাটি বিশেষ মনোযোগ সহকারে পড়লাম এবং সময় ব্যয় করে মতামত জানাতে উদ্যোগী হলাম। গোড়াতেই বলে রাখি, আমার বক্তব্য আপনার এবং অনেকেরই অপছন্দের বিষয় হবে জেনেও আমার মতামত প্রকাশ করছি। সর্বজনের জন্য এই মতামত প্রকাশ করবেন কি না, সেই চাবিকাঠি অবশ্যই আপনার জিম্মায়।
যেটা সব থেকে কটুভাবে নজরে এলো, সেটা এই যে, আপনার লেখায় কোথাও ‘পরবাস”-এর উল্লেখ নেই। এই সময়ে পরবাস-ই হচ্ছে উত্তর আমেরিকার সর্বজনগ্রাহ্য অগ্রগন্য পত্রিকা। এই একটি মাত্র পত্রিকা যেখানে ‘সাবস্টেন্স’ থাকে।
আপাততঃ অচল হলেও সামান্য কিছুদিনের জন্য বাংলা সাহিত্য-কে প্রবাসে রস জুগিয়েছিল ‘উড়ালপুল।’ সে নামও উল্লেখ করেননি।
বঙ্গ সম্মেলন কর্তৃপক্ষ তাঁদের ব্যবসায়িক কারণে এবং একমাত্র তাঁদের ব্যবসায়িক কারণে বাংলার সংস্কৃতি থেকে শত হস্ত দূরে থাকেন, একথা আমি-আপনি এবং অনেকে স্পষ্টভাবে আগেও বলেছি প্রকাশ্যে, বিশেষ করে এ্যাটলান্টিক সিটিতে বঙ্গ সম্মেলনের পরে। মনে আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু প্রবাসের বাঙালিকে একত্র করে বাৎসরিক এই তিনদিনের ধামাকা উপহার দেবার কর্মযজ্ঞে বঙ্গ সম্মেলন অব্যর্থ এবং নিপুনভাবে সেই কাজ পালন করে চলেছেন। সেকারণেই আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই।
মুশকিল হচ্ছে, আমরা জেনেবুঝেই যেমন আশা ভোঁসলের গানের আসরে বাংলা সাহিত্যের পসরা সাজিয়ে বসতে যাই না, ঠিক তেমনই আমাদেরই অনুচিত বঙ্গ সম্মেলনের মতো আসরে বাংলা সাহিত্য রসিক খোঁজার প্রয়াস। যথার্থ বাংলা সাহিত্য বলতে যা বোঝায় এবং যাঁরা সে ‘আভিজাত্য’ অনুভব করেন, তাঁরা কিন্তু পৃথক আসরে (আয়তনে অনেক ক্ষুদ্র হলেও) প্রায় নেপথ্যে থেকে বাংলা সাহিত্যের কাজকর্ম দক্ষতার সঙ্গে করে চলেছেন। আমরা না তাঁদেরকে স্মরণ করি, না তাঁদের পরোয়া করি। কারণ আমাদের অভীষ্টটাই আলাদা। মুড়ি-মিছরি এক করে সকলকে বাংলা সাহিত্যের পাঁচন গিলিয়ে, আমাদের নিজেদের পায়া ভারী করাটাই মূল লক্ষ্য।
সেকারণেই শ্রীজাত, বিনায়কের মতো লোকেরা আদরণীয় হয়ে ওঠে। সাহিত্যের আসরে এদের নাম কে কতবার কোথায় প্রকাশ করেছেন এবং সেই সুবাদে এরা কতটা জনগ্রাহ্য সেটাই মাপকাঠি হয়ে ওঠে। একইভাবে, আরও যাদের নাম উল্লেখ করেছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই যোগ্যতায় নয়, বরং ১) তাবেদারি করার রপ্ত কৌশলে, ২) অর্থের ক্ষমতায় এবং ৩) পদাধীকার বলে আপনার নির্ধারিত মঞ্চে ওঠার সুযোগ আদায় করে নিয়েছেন। বাকি যারা দর্শক/শ্রোতা, তারাও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন যে, এরাই বাংলা সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক।
আপনার কাছে কী যথার্থ কোনো তূলাদন্ড ছিল বা রয়েছে যার নিরীখে আপনি যাচাই করে নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই প্রতিনিধিত্ব? দায়িত্বপ্রাপ্ত উদ্যোক্তা হিসেবে বিচক্ষণতার সঙ্গে আপনি সেই দায় এড়িয়ে গিয়েছেন। নয়তো যে মানুষ বিগত মাত্র এক বছরে শুধুমাত্র অর্থ এবং কেবলমাত্র অর্থের জোরে বাঙালি সাহিত্যিকদের কিনে নেবার এবং গোটা উত্তর আমেরিকার বাংলা সাহিত্যপ্রেমীদের সম্মোহিত করবার স্বপ্ন দেখে চলেছেন (স্পিলবার্গের ‘পিংকি এ্যান্ড দ্য ব্রেইন’-এর কথা মনে পড়ে গেল), তিনি কোন যোগ্যতায় বঙ্গ সম্মেলনের মতো আসরে বাংলা সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ আদায় করে নিলেন? আমি প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দাবী করছি যে, ২০১২ সালের আগে বাংলা সাহিত্যে তার অবদান কী, তিনি কী করেছেন, সে কথা সকলকে জানান।
ভাববেন না ব্যক্তিগত বিষোদ্গার করাই আমার এই লেখার উদ্দেশ্য – তাহ’লে আমি জনে জনে ধরে বলতে পারি প্রায় প্রত্যেকের সম্পর্কে যাদের নাম আপনার লেখায় ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সে আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার বক্তব্য এই যে, প্রতিবার বঙ্গ সম্মেলন হয়ে গেলে পরে, একবার করে নিয়মমাফিক গালিগালাজ করে লাভ কী? একথা কী কারও অজানা যে, উত্তর আমেরিকার শিল্পীরা বঙ্গ সম্মেলনে কোনোদিনও অগ্রাধিকার পাবেন না – বা বাংলা সাহিত্য অথবা বাংলা সিনেমা কোনদিনও মূল আকর্ষণের ধারে কাছে আসবে না – কারণ উদ্যোগটাই তো সেই উদ্দেশ্যে নয়। তবু আমরা পয়সা খরচ করে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে প্রতি বছর বঙ্গ সম্মেলনে যাব এবং তারপর কেন শ্রেয়া ঘোষাল বা বাপ্পি লাহিড়ী মূল আকর্ষণ হয়ে উঠলেন, কেনই বা বঙ্গ সম্মেলন উদ্যোক্তারা তাদের জন্য বেশী পয়সা খরচ করলেন আর আমাদের দিকে নজর দিলেন না, সেই নিয়ে কচকচানী করবো – এ নেহাৎই শিশু সুলভ চপলতা (যেমন কোন বাচ্চাকে বলতে শুনেছি তার মা বাবাকে – ‘তোমরা নিজেদের পছন্দ বলে অমুক জিনিষটা এত্তগুলো টাকা খরচ করে কিনে আনলে আর আমার একটা গেম বয় গেম কিনতে গেলে বল টাকা নেই!’)।
বরং আপনার মতো সমাজ সচেতন দায়িত্ববান মানুষের কাছে আশা রাখবো যে, ভবিষ্যতে আবার যখন সুযোগ পাবেন, তখন যেন আরও অনেক ভেবেচিন্তে, আরও অনেক খোঁজ খবর নিয়ে এবং অধ্যবসয়ের সঙ্গে সাহিত্যিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচন বা মনোনয়ন করবেন। “কানামাছি ভোঁ ভোঁ – যাকে পাবি তাকে ছোঁ” এই খেলা তো বহুদিন হলো। এবার বরং দায়িত্বপ্রাপ্তেরা যথাযথ সুবিচার করুন বাংলা সাহিত্যকে। সততা বিরাজ করুক অন্ততঃ সাহিত্যের আসরগুলোতে। বাংলা সাহিত্য তো ‘এন্টারটেইনমেন্ট’ নয়, বাংলা সাহিত্য হচ্ছে ‘এনলাইটেনমেন্ট’। সেই কাজে যারা স্বভাবে-চরিত্রে, কথায়-কাজে নিষ্ঠার সঙ্গে নিয়োজিত তাঁদের পরিচিতি করানো এবং জনসমক্ষে তুলে ধরার নৈতিক দায়িত্ব উদ্যোক্তাদেরই। সেখানেই যদি সর্ষের মধ্যে ভূত রয়ে যায়, তাহ’লে ….. তাহ’লে যা হবার তাই হয়ে চলেছে সমগ্র ‘বাঙ্গালিস্তান’ জুড়ে। সেই নিধনযজ্ঞে আরও ঘি নাই বা ঢাললেন। যাদের দোহাই পেড়ে আমরা বাংলা ‘কিস্টি’ ও ‘সন্সকিতি’ করে চলেছি, সেই পরবর্তী প্রজন্মকে আরও বিভ্রান্ত নাই বা করলাম। বিশেষ করে গৌরী সেন-দের সঙ্গে ‘সন্সকিতি’র সম্পক্ক যে স্বর্গ-নরকের ব্যবধান, সে সত্য কাহিনী প্রাচীনকালেও ছিল, আজও বয়ে চলেছে। সেই ট্রাডিশন কী সমানেই চলবে?
প্রবীর, আপনার মতামতের জন্য ধন্যবাদ। প্রথমতঃ বলি, প্যানেল ডিসকাসন-এ পরবাস এবং দুকুলের কথা আলোচিত হয়েছিল। আমরাই অনবধনাতার কারণে তা এই রচনায় উল্লেখিত হয়নি। আমি সে ভুল সুধরে দিয়েছি। ভুল ধরিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ।
কিন্তু আপনার কিছু কিছু উক্তি রীতিমত আপত্তিকর, এবং আমি তার তীব্র নিন্দা করছি। শ্রীজাত এবং বিনায়ক-এর মত লেখক তাদের নিজেদের গুণেই আদরণীয়, অন্য কোন কারণে নয়। এরা দুজনেই তরুণ প্রজন্মের প্রতিষ্ঠিত কবি এবং সাহিত্যিক। আপনার আমার স্বীকৃতির অপেক্ষা তারা করে না। সুতরাং তাদের প্রতি আপনার এই বক্রোক্তির আমি তীব্র প্রতিবাদ করছি।
কিন্তু আপনার লেখা পড়ে মনে হল, আপনার মূল ক্ষোভ রবিবারের প্যানেল ডিসকাসন-এর বক্তাদের নিয়ে। প্যানলে যারা ছিলেন, যেমন রাহুল রায়, অঞ্জলি ভট্টাচার্য, আলোলিকা মুখোপাধ্যায় এবং ভারতী চৌধুরী – এরা প্রত্যেকেই দীর্ঘদিন ধরে বাংলা সাহিত্যের চর্চা করে চলেছেন। দেশে বিদেশে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় তাদের লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তাদের লেখার সঙ্গে আমি বিশেষ ভাবে পরিচিত। সুতরাং তাদের প্রতি আপনার অপমানজনক উক্তি অত্যন্ত নিন্দনীয়।
শর্বরী গুপ্ত দুকুল পত্রিকার প্রকাশক এবং সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। পত্রিকা প্রকাশের অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু বলার জন্য আমি তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম, এক বছর আগেও যে পত্রিকার সম্পাদক আপনি ছিলেন। সুতরাং পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য-র সঙ্গে আপনি সহমত, এটা ভাবাটা অযৌক্তিক নয়। সুতরাং সেই পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে উনি যদি তার অভিজ্ঞতা আমাদের জানান, তাতে আপত্তির কোন কারণ আছে বলে তো আমি মনে করিনা। আপনি যদি আজ সম্পাদক থাকতেন তাহলে হয়ত আপনিই মঞ্চে এই কাজটা করতেন। গত বছর এই প্রসঙ্গে আপনার সঙ্গে আলোচনাও হয়েছিল এবং তখন আপনি আমাকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। আজ তাহলে আপত্তি জানাচ্ছেন কেন? (প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি, পরবাস পত্রিকার সম্পাদক সমীর বাবুকে আমি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম, কিন্তু উনি বঙ্গ সম্মেলনে আসছেন না জানিয়েছিলেন।)
বঙ্গ সম্মেলনের এই সাহিত্য আলোচনা কখনই শেষ কথা হতে পারে না। তাছাড়া, যারা মঞ্চে দাড়িয়ে তাদের বক্তব্য রাখছেন, তারা বাংলা সাহিত্যের প্রতিনিধি হিসেবে নয়, অভিবাসী বাংলা সাহিত্যের একজন কর্মী হিসেবে তাদের অভিজ্ঞতা “শেয়ার” করেছেন। তাদের এভাবে অপমান করাটা আমি কখনই সমর্থন করি না।
আমি যা ভাবছি করছি তাই ঠিক আর অন্যেরা সব দুচ্ছাই, এটা ভাবা ঠিক নয়।
সুদীপ্ত,
ধন্যবাদ এবং তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ সমাসনে গ্রহণ করলাম। বুঝতে পারছি, আমার বক্তব্য প্রকাশে কিছু গলদ রয়ে গিয়েছিল, নতুবা, যে কথা বলেছি, আপনি তার কেন্দ্র ছেড়ে বৃত্ত বলয়ে – কখনো বা কক্ষপথ ছেড়ে আরও দূরে চলে গিয়ে আপনার ধিক্কার প্রকাশ করতেন না।
আপনার জবাবের প্রত্যুত্তরে লেখনীয় কিছুই নেই। কারণ অধিকাংশই আমার বক্তব্য নয়। কিন্তু যে কথা আপনি ইলাস্টিকের ন্যায় টেনে এনেছেন, সে বিষয়ে কয়েকটি কথা না জানিয়ে রাখলে অকারণ ভুল সংকেতের অবকাশ রয়ে যাবে।
প্রসঙ্গক্রমে এ’কথাও জানিয়ে রাখা উচিৎ ‘বক্রোক্তি’ বা ‘দুচ্ছাই’ কোনোটিরই অভিপ্রায় আমার ছিল না এবং নেই-ও। বন্ধুত্বের সাবলীলতার একটি প্রধান অঙ্গই হলো একে অপরকে নিঃস্বার্থ ও স্বতস্ফূর্ততার মধ্যে দিয়ে সময়ে অসময়ে সহযোগিতা করা যাতে পরস্পর জীবনের একটি ধাপ থেকে পরের ধাপে উত্তীর্ণ হ’তে পারে। অতএব এক্ষেত্রে নিছক সমালোচনা না করে আমি গঠনমূলক আলোচনাই করতে চেয়েছিলাম। এবং তার একমাত্র কারণ আপনি যিনি ‘রণ’এর রচয়িতা। এই একই লেখা যদি আমার অপরিচিত বা অন্য কেউ লিখতেন, এর পিছনে আমি বিন্দুমাত্র সময়ও ব্যয় করতাম না।
এবারে মূল কথায় আসি। শ্রীজাত এবং বিনায়ক, দুজনের একজনকেও আমি লেখক হিসেবে কোথাও খাটো করতে চেয়েছি বলে তো নজরে পড়ছে না। আমি লিখেছিলাম, “শ্রীজাত, বিনায়কের মতো লোকেরা আদরণীয় হয়ে ওঠে।” এর মধ্যে তাদের লেখা কে তো কোথাওই অসম্মান করিনি। করেছি কী? আসল প্রশ্নটাতো ছিল আপনার উদ্দেশ্যে। গোটা লেখাটাই আপনার উদ্দেশ্যে। আপনি যেমন বঙ্গ সম্মেলনে সাহিত্যের আসরে কী হয়েছে সেই প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে কিছু নাম লিখেছেন, আমিও ঠিক সেরকমই আপনার কাছে কিছু প্রশ্ন পাঠাতে গিয়ে উদাহরণ স্বরূপ আপনার ব্যবহৃত নামগুলির মধ্যে কয়েকটি ব্যবহার করেছি মাত্র। আসল প্রশ্ন যেটা আপনার কাছে ছিল, তা হ’লো, কোন তুলাদণ্ডের মাপকাঠিতে আপনি এদেরকে সম্মেলনে আহ্বান জানিয়েছিলেন? (এখন আর এই প্রশ্নটি আমার জিজ্ঞাস্য নয়, কারণ উত্তর আমি পেয়ে গিয়েছি) আমি এবং আপনি উভয়েই জানি, বিনায়ককে আপনি আমন্ত্রণ জানাননি। বিনায়ক এসে গিয়েছিল অন্য সূত্র ধরে যা আপনি লিখেওছেন। বিনায়কের আমেরিকা আগমনের মূল গপ্পোটা আমার নখদর্পনে কারণ ওর আমেরিকা আসার সুযোগের সূত্রপাত আমিই ঘটিয়েছিলাম। (চাইলে প্রমাণ দিয়ে দিতে পারি।) সে যা হোক, আপনার সঙ্গে একটি বিষয়ে আমি ১০০% সহমত। ওদের প্রতিষ্ঠা এবং প্রতিষ্ঠান কোনোকিছুই আমার স্বীকৃতির অপেক্ষা বা তোয়াক্কা রাখে না। তেমন কোনো হরিদাস আমি নিজেকে মনে করিনি কোনোদিনও।
“কিন্তু আপনার লেখা পড়ে মনে হল, আপনার মূল ক্ষোভ রবিবারের প্যানেল ডিসকাসন-এর বক্তাদের নিয়ে।” আপনি লিখেছেন। এটিও সর্বৈব ভুল। আদতে কোনো ক্ষোভই আমার ছিল না বা নেই। অতএব তাদের একজনকেও অপমান করার কোনো অভিপ্রায়ই আমার নেই। বরং রাহুল দা-র সঙ্গে আমি সবিশেষ পরিচিত এবং ওনার সুদীর্ঘ সাহিত্য প্রীতি ও চর্চাকে আমি সম্ভ্রম করি। বাকিদের কাউকেই আমি চিনি না এবং লেখাও পড়িনি। তবে আমার আগের লেখাটি পড়ে বেশ বুঝতে পারছি কোথায় আমার প্রকাশে গণ্ডগোল পাকিয়েছি যার ভিত্তিতে আপনি এমন মন্তব্য করেছেন। এই ভ্রান্তির জন্য আমি যারপরনাই দুঃখিত। ব্লগে সরাসরি লেখার একটা ‘ডিসএ্যাডভান্টেজ্’ এই যে লেখার সময় উপরে সরে যাওয়া মূল লেখাটি দেখা যায় না এবং স্মৃতিশক্তির উপর কার্যত নির্ভরশীল হয়ে লিখে যেতে হয়, যেটি বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ অধোমুখী।
এরপরেই আপনি টেনে এনেছেন দুকূল পত্রিকার কথা। আর এখানেই কিন্তু (হয়তো বা আপনারই অজান্তে) আপনি আমার মূল বক্তব্যের সঙ্গে সহমত হয়ে গিয়েছেন। আপনার যুক্তিটা এখানে সেই ‘পৈতে না থাকলে বামুন নয়’, সেইরকম হয়ে গিয়েছে। দুকূল-এর সঙ্গে আমার সম্পর্কচ্ছেদের পর এ যাবৎ মোট সাতজনকে মূল ঘটনা বলেছি, যার মধ্যে আপনি একজন। বহু পরিচিত-অপরিচিত শুভানুধ্যায়ী জানতে চেয়েছিলেন নেপথ্য কাহিনী। বলিনি। কারণ এটা বলার মতো কোনো সুখদায়ক কাহিনী নয়। দুকূল-এর মালিকপক্ষকে আমি একদিন অত্যন্ত কাছের মানুষ বা বন্ধু বিশ্বাসে তাদেরই আবেদনে সাড়া দিয়ে তাদেরই অভিলাষ পূর্ণ করতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। একদিন যখন তাদেরকে বন্ধু-সম্মান দিয়েছিলাম, আজ তাদের অহেতুক নিন্দা করতে গেলে আকাশের দিকে মুখ করে থুথু ছোঁড়ার ঘটনা হয়ে যাবে (জানা আছে, তারা যদিও এই দর্শনে বিশ্বাসী নন)। আজও কিন্তু আমি তাদের বন্ধু হিসেবেই স্মরণ করি এবং তাদের বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ থাকলেও কোনো অভিমান বা বিদ্বেষ নেই। অতএব আপনি এই প্রসঙ্গ টেনে আনলেও আমি এই ব্যক্তি সম্পর্কে একটিও কথা বলতে আগ্রহী নই। কিন্তু তাই বলে, যে লোকটি প্রবাসে বাংলা পত্রিকা প্রকাশের জন্য মাটি খুঁড়ল, বীজ পুঁতল, জল-ছায়া দিল, চারা গজানো করালো, তাকে বাঁচিয়ে বড় করে তুলল, সেই লোকটি নেহাৎ সম্পাদকের তকমা কাঁধে বা পিঠে না থাকার অপরাধে এই প্রাসঙ্গিক অভিজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ থেকে বাতিল হয়ে গেল? গর্ব করে – বগল বাজিয়ে নয়, বরং যৌক্তিকভাবে এবং সবিনয়ে জানতে চাই যে, এই দেশে বাণিজ্যিকভাবে বাংলা পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে আমার তুলনায় অধিক অভিজ্ঞ একজনকেও আপনি দেখাতে পারবেন কী? এটা কিন্তু কেবলমাত্র আপনার কথার বা অযৌক্তিক ‘যুক্তির’ পিঠে লিখলাম। এখান থেকে কিন্তু এক লহমার জন্যও ধারণা করে নেবেন না যে, আপনার ওই মঞ্চে বাতিল হয়ে যাবার কারণে আমি বিষোদ্গার করেছি (একথা আমি আগেও লিখেছি।) কিন্তু এখানেই তো প্রকাশ হয়ে যায়, আপনার নির্বাচনের বা মনোনয়নের মাপকাঠিটা কতটা নড়বড়ে। জানবেন, আজও দুকূল চলছে আমার এবং একমাত্র আমারই হাতে তৈরী করা পরিকাঠামোর উপর নির্ভরশীল হয়ে। এর সঙ্গে যুক্ত সমস্ত কুশলী আমারই চয়ন করা এবং যারা লেখেন তাদের ৯৫%ই আমার পরিচিতি থেকে – যার মধ্যে একজন হচ্ছেন সুযোগসন্ধানী বিনায়ক। দুকূল চালু হবার পরে অনেকের মতই আপনিও সন্দিহান ছিলেন যে এই পত্রিকা বেশীদিন চলবে কিনা (একথা আপনার ব্লগেও আপনি লিখেছিলেন), তখন আপনাকে আমি আশ্বস্ত করেছিলাম যে, দেখে নেবেন এই পত্রিকা চলবেই। আমার সে কথা যে ভুল প্রমাণিত হয়নি, এজন্য দুকূল কর্তৃপক্ষেকে আমি অভিনন্দন জানাই। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, “এক বছর আগেও যে পত্রিকার সম্পাদক আপনি ছিলেন। সুতরাং পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য-র সঙ্গে আপনি সহমত, এটা ভাবাটা অযৌক্তিক নয়।” বলতে বাধ্য হচ্ছি এই ভাবনা বা ধারণা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
আসল কথা হচ্ছে যে, প্রায় প্রতিবার বঙ্গ সম্মেলন শেষ হয়ে যাবার পর, আপনি আপনার ব্লগে আমেরিকার অনুষ্ঠান, সাহিত্য আসর, সিনেমা বাসর ইত্যাদি ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের বৈমাতৃসুলভ আচরণের মৃদু বিরোধিতা করে থাকেন। সেই সূত্র ধরেই আমি বন্ধু হিসেবে আপনাকে কয়েকটি প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম মাত্র। তার বেশী কিছু নয়। কিন্তু আপনি সেই প্রসঙ্গের কেন্দ্রচ্যূত হয়ে বহুদূরে চলে গেলেন। তাই আবারও সেই একই প্রশ্ন রাখি সুদীপ্ত। এবং বন্ধু মনোভাব থেকেই রাখছি। কেন জেনেশুনে বারবার অর্থাৎ যখনই সুযোগ এসে যায়, এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন, এবং তারপর অভিযোগ করেন কেন? বাংলা সাহিত্যের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে যেটুকু টাকা বা বাজেট বরাদ্দ হয়ে থাক না কেন, তা দিয়ে কী আর একটু বেশী চিন্তাশীল হওয়া যেতো না? এখানে যদি ধরেই নিই যে, সুচিন্তনের অভাবে – বঙ্গ সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের মতই আপনিও কেবলমাত্র ‘গ্ল্যামার’ হাজির করার পন্থা অবলম্বন করেছিলেন, তাহলে কী আরও একবার আমাকে তীব্র নিন্দা জানাবেন? সে কারণেই কী আপনার শ্রীজাত, বিনায়ক, হর্ষ-র প্রতি আকর্ষণ? (আবারও বলছি এদের লেখাকে আমি খাটো করার মত ধৃষ্টতা দেখাতে চাই না।) (হর্ষ আসেননি ‘অনিবার্য’ কারণে, কিন্তু কেন যে আসেননি সে কথা আপনি-আমি উভয়েই জানি।) মুশকিল হচ্ছে এই যে, যে কোন কারণেই হোক, বাংলার লেখক-লেখিকাদের সঙ্গে কার্যক্ষেত্রে আমার যোগাযোগ দীর্ঘদিন যাবৎ কিছুটা রয়েইছে। সেই কারণেই হাঁড়ির খবরও যেমন অজানা থাকে না, আবার একই কারণে কে কি লিখছেন – কী ধরণের সাহিত্য করছেন – ইত্যাদি খবরাখবরগুলোও কর্ণগোচর হয়। আপনি তো আমার তুলনায় অনেক বেশী ভাল করে জানেন যে, বঙ্গ সম্মেলন কাদের টাকায় সম্ভব হয়! সুদীপ্ত সেন-এর কোটি টাকার অনুদানের কথা তো আজ আর কারো অবিদিত নয়। আমরা পৃথিবীর উন্নততম এবং ধনীতম দেশের বাসিন্দা হয়ে গর্ব করি, কিন্তু আমাদের দেওয়া ‘রেজিস্ট্রেশন’ বঙ্গ সম্মেলনের এই রাজকীয় হালচাল বজায় রাখার ক্ষেত্রে ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করে। তাহ’লে যে কোলকাতা থেকে ঢালাও টাকা আনতে হয়, সেখানকার অনুষ্ঠানই প্রাধান্য পাবে, একথায় আশ্চর্যের কী আছে! এই তো এই বছরেও, যে পত্রিকার আনুষ্ঠানিক প্রকাশের কথা আপনার প্রতিবেদনে লিখেছেন, সেই পত্রিকা তৈরী করার খরচা আদায় করার জন্য কতই না জল ঘোলা হয়েছিল কোলকাতায়! কত অবমাননাকর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল! আপনার তো তা অজানা থাকার কথা নয়। সেই আসরে বসে – মূল আয়োজকদের মত একই পথে আপনিও চিন্তা করবেন (অন্ততঃ বাইরে থেকে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বলেই বলছি, কিন্তু একইসঙ্গে মেনে নিচ্ছি যে হয়তো বা আপনি এত কিছু ভাবেনইনি, শুধুমাত্র ট্র্যাডিশন বজায় রেখেছেন হয়তো), সাহিত্যের গ্ল্যামারবয়দের আনানোর বন্দোবস্ত করবেন, তারপর কখনো অর্থের অভাবের জন্য – কখনো বা দর্শকের অভাবের জন্য অনুযোগ জানাবেন – সেটা কী ঠিক? সাহিত্যিক না সাহিত্য কোনটা বেশী জরুরী? আপনি অবশ্যই বলবেন সাহিত্য। তা যদি সত্যই হয়, তাহলে পরবর্তী সুযোগে আপনি আরও বেশী চিন্তাশীল হবেন, এইটুকুই আশা। আপনি যথেষ্ট পড়াশুনো করেন বলেই আমার ধারণা, যেকথা আপনি আপনার জবাবে লিখেওছেন, তাছাড়া আপনি একজন যথার্থই চিন্তাবিদ। রণ-এর মত নাটক আপনার কলম থেকেই বেড়িয়েছে। আপনার মত মানুষের কাছে এই আশা করাটা নিশ্চয়ই অবান্তর নয়। এই কথাটুকুই বলতে চেয়েছিলাম। তার বেশী কিছু নয়।
শেষ করার আগে একটা কথা প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখি। আমার সংগ্রহে নয় নয় করে প্রায় তিনশো লিটল ম্যাগাজিন্ রয়েছে। হ্যাঁ এই আমেরিকার বাসাতেই। বঙ্গ সম্মেলনের কর্তৃপক্ষকে আমি আবেদন জানিয়েছিলাম যে, সাহিত্য আসরের আশেপাশে কোথাও একটু জায়গার ব্যবস্থা করে দিতে। জানিয়েছিলাম, যে কোনকিছুই বিক্রিবাটা করবো না, শুধুমাত্র প্রবাসী বাংলা সাহিত্যপ্রেমীদের সামনে এই সংগ্রহ তুলে ধরতে চাই প্রদর্শনীর আকারে, যাতে করে আগ্রহী লেখকেরা নতুন নতুন পত্রিকায় লেখা পাঠানোর সুযোগ পেতে পারেন, নতুন নতুন বা বিভিন্ন ধরণের লেখার এবং লেখকের সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন। এই বিশাল সংগ্রহ গাড়ী করে বয়ে নিয়ে যাবার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থব্যয় আমিই করব এমনও জানিয়েছিলাম। রেজিস্ট্রেশন খরচও দিতে রাজী ছিলাম। আমাকে শুধু জায়গাটুকুর বরাদ্দ দেবার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। তারা কানেই নেননি এই প্রস্তাব। কেন জানেন? কাদের প্ররোচনায় জানেন? যাক গে –
এই বিষয়ে অনেক সময় দিয়ে ফেলেছি। অতএব এর পরে এই বিষয়ে আর কিছু লিখবো বা বলবো না। হাতে অনেক কাজ। সামনেই প্রায় এসে গেল, সাউথ এশিয়ান থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল। অতএব সেই ব্যস্ততায় ফিরে গেলাম আবার।
আপনার এবং সকলের শুভ ও মঙ্গল কামনা করি।
প্রবীর।
শুধু বাংলা নয়, যে কোনো দক্ষিণ এশিয় ভাষায় প্রকাশিত সর্বপ্রথম ওয়েব পত্রিকা বা জালিকা ‘পরবাস’। তার উল্লেখ লেখাটায় দেখে ভালোলাগলো। কিন্তু সর্বপ্রথম বাংলা কবিতার ওয়েব পত্রিকা “কৌরব অনলাইন”, যা আমি ১৯৯৮ সাল থেকে সম্পাদনা করে আসছি তার কোনো উল্লেখ নেই দেখে অবাক হলাম। কৌরব শুধুমাত্র বাংলা কবিতাই নয়, আন্তর্জাতিক কবিতা পত্রিকা যেখানে অন্যভাষা ও দেশের কবিরাও লিখে থাকেন।
Dear Sudipta,
I am enchanted and feel honoured to see the way you have described the output of our literary seminar in NABC2014 which has never been done before like this. You have covered all the participants and the essence of their speech and your opinion which gives all of us a glorious feedback. We are very much sympathetic to those who could not attend to this grand ceremony as they missed flights. I very much appreciate your capacity to organise the Literary seminar in such a wonderful way. I am spellbound to see that you kept your cool amidst the change and loss of flight from New Jersey but at last arrived to give us delight. Viva NABC Viva your effort. Bharati-di (Mrs.Chowdhury)from London,England.
একটা বিনীত আবেদন জানাই। সাহিত্যসভার আলোচনায় কাগজপত্র, সাহিত্যধারা, লেখ-ঐতিহ্য ইত্যাদির মধ্যে আলোচনাকে বেঁধে রাখাই কি সমীচীন নয়? ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ না এলেই বোধহয় ভালো হতো।
Sonibar sokaler sahitto alochona o bekeler kobita path r asore ame thakte perechilam. Amar besh valo legeche. Songothokder dhonnobad. Agami dene aro valo onusthaner opekkhai roilam. Sokole valo thakun.
সুদীপ্ত,
এবারে বঙ্গসম্মেলনে সাহিত্য সম্মেলনের প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানে সুন্দর পরিকল্পনার ছোঁয়া খুব উপভোগ করেছি । প্রিয় সাহিত্যিক ও আমাদের মত পাঠকদের পারস্পরিক আদানপ্রদানের সুযোগ দেবার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। আলোলিকা দি, বিনায়ক আর শ্রীজাতর সাথে আড্ডায় অনাবিল আনন্দের অভিজ্ঞতা, কবিতাপাঠের আসরে বিনায়ক আর শ্রীজাতর কবিতা নির্বাচন বহুদিন মুগ্ধ করে রাখবে। সেই সাথে আরো কত সুন্দর কবিতা শোনার অবকাশ হল।
বঙ্গসম্মেলনের আমন্ত্রনে এবং দুকূলের sponsorship এ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়কে এ দেশে আনতে পারায় দুকূল সম্মানিত। আগামী মাসে Iowa University আয়োজিত International Writers’ workshop এর আমন্ত্রণে তিনি আবার আমেরিকায় আসছেন।উল্লেখ্য যে বাংলাভাষায় যাঁরা লেখালেখি করেন তাঁদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, শঙ্খ ঘোষের পর নতুন প্রজন্মের শ্রীজাত এবং বিনায়ক এই বিরল সম্মান লাভ করেছেন। এত ব্যস্ততার মধ্যেও যে আমাদের অনুরোধে বিনায়ক স্বল্প সময়ের জন্য এ দেশে এসেছেন, এর জন্য আমরা তাঁর কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। তাঁর কবিতা ও তাৎক্ষনিক তৈরি করা গল্প সারাদিন ওই চত্বরে সবার মুখে মুখে ফিরেছে।
শ্রীজাত এখন বাংলাসাহিত্যে একটি ভালবাসার নাম। তাঁর মায়াবী কবিতাগুলি কানে নয়, বুকে এসে বেজে ওঠে। কবিতাপাঠের আসরে তাঁর আন্তরিক পরিবেশনা আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। শ্রোতারা তাঁর নাম দিয়েছিলেন ইচ্ছেকবি।
আপনাকে ধন্যবাদ জানাই দুদিন ধরে এই আনন্দ-পরিবেশ রচনার জন্য। আপনার সপ্রতিভ সঞ্চালন খুব উপভোগ করেছি।
বাংলার জন্য ……….
সুদীপ্ত-দার লেখা পরে মন হলো কিছু লিখি বঙ্গসম্মেলন, বাংলা ও বঙ্গবাসী (অধুনা বা একদা) প্রসঙ্গে :
আমার কোনো দিন ইচ্ছে ছিল না আমেরিকা তে থেকে যাবার । প্রতি বছর-ই ভাবতাম এবারে নিশ্চয়ই ফিরে যেতে পারব, কিন্তু বিভিন্ন কারণে দু-যুগ এর ওপর পেরিয়ে গেল, ফেরা আজও হলো না । আমার অভিব্যক্তি হয়ত পরিচিত বহু অভিবাসী বাঙালির কাছে, তবু বলছি। এদেশে এতদিন থাকার ফলে সুখে–দুঃখে মিশে গেছি একদা ভিন-দেশীদের সাথে। তারা অনেকেই আমার পরিচিত বাংলা ভাষী অনেকের থেকেই অনেক কাছের। দিনের বেশিরভাগ সময়েই আমাকে ইংরেজীতে কথা বলতে হয়, গানের জন্যও আজকাল দেখি গাড়িতে শুনি এখানকার FM চ্যানেল -এ rock বা rap আর নাহলে Public Radio ।
তবু……..
মনের মাঝে যত্ন করে রেখেছি বাংলা-কে; সে বড় আদরের আর বড় ভালবাসার জায়গা। লিখি, পড়ি , গান-শুনি, কেউ বলছে শুনলে ছুটে যাই শুনতে আর শোনাতে । বঙ্গ সম্মেলন বা বঙ্গ মেলার মত বছরে একবার আয়োজিত যজ্ঞকান্ড যথেষ্ট নয় সাহিত্য প্রয়াসে কারণ সাহিত্যের দিকটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুয়োরানীর মত রাজপ্রাসাদ হতে দূরে অনাদরে । বেশ কিছু বছরে বঙ্গ-সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী হিসেবে আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি সব কিছু জেনেও, সব উপেক্ষা ঠেলে যারা ভালবাসেন তারা মেঠো পথ পেরিয়ে ভিড় জমান সাহিত্য বাসরে । একদিনের আসর হলে সেই পাঠক, শ্রোতা, সাহিত্যিক সবাই চেয়েছেন কেন নয় দুদিন, আবার একঘন্টা হলে চাহিদা এসেছে দু-ঘন্টার । এবছরের বঙ্গ সম্মেলন ও এর কোনটার থেকেই ব্যতিক্রম নয় । অনেক কিছু করা যায়, করা যেত, করা উচিত এসব তর্কের বাইরে বেরিয়ে যতটুকু পেয়েছি খুশি হয়েছি, অন্যান্য অনেক আকর্ষণ উপেক্ষা করে ভিড় জমিয়েছি সাহিত্য আসরে । আলাপ করার সুযোগ পেয়েছি আরও কিছু সাহিত্যপ্রেমীর সাথে, পরিচিত হবার সুযোগ পেয়েছি দেশে ও বিদেশে বর্তমান সাহিত্য চর্চার সম্বন্ধে ।
ভালবাসার এই নিয়ম, সে আঁকড়ে রাখে, সে ছড়িয়ে দিতে চায় ওই ভালবাসা সবার মাঝে। তাই যাদের হৃদয়ে বাংলার জন্য স্থান আছে তারা একত্রিত হয়, চেষ্টা করে সেই বাংলাকে কি করে ধরে রাখা যায়, আর তার সঙ্গে বাঁচিয়ে রাখার জন্য পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হাত পাতে।
হাঁ, এটা হয়ত ঠিকই যে আমরা হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে এগিয়ে যাচ্ছি এক সর্বভৌম ভাষার দিকে,; অনেক ভাষা অবলুপ্ত এবং আরও কিছুদিনের মধ্যে আরও অনেক ভাষা অবলুপ্তির পথে পা বাড়াবে | যেমন এটা ঠিক যে একদা বাধ্যবাধকতামূলক পাঠ্য থেকেও সংস্কৃত প্রায় অবলুপ্ত । কিন্তু যে আদি গ্রন্থ রচনা হয়েছে সংস্কৃতে সে সব-ই তো সত্য, সব-ই সজীবিত; কারণ ভারতবাসী হয়ে রামায়ণ-মহাভারত-বেদ-উপনিষদ-গীতা কে বাদ দিলে যে আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের গর্ব, আমাদের প্রাচীন-সভ্যতাকেই অস্বীকার করা হবে। ভাষার সাথে জড়িয়ে থাকে ইতিহাস। ভাষাবিদ, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক এদের সবার কাছেই সংস্কৃত ভাষার অবদান অনেক। সেইরকম-ই বাংলা ভাষায় যে সাহিত্য, যে গান সৃষ্টি হয়েছে তা কি অবলুপ্ত হতে পারে? এইভাবেই বাংলা বেঁচে থাকবে যারা ভালোবাসে তাদের মাঝে ।
বাংলায় থেকে বাংলা ভাষায় কথা বলার সংখ্যা কমে যাচ্ছে, বাংলার বাইরে থেকে তা আরও কঠিন। তবে ওই যে বলছিলাম, নিজের ভালোলাগার জন্য আমরা কিছু করি । ১৯ বছর বয়েস এবং এদেশে ভূমিষ্ঠ পুত্র আমার যখন দুই ভাষায় কথা বলে ও গান করে ভালো মত দক্ষতার সঙ্গে আমার ভালো লাগে; কারণ ওই একটাই, আমাদের ভালোলাগা তার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পেরেছি। দেশে গেলে সে নিজেকে লুকিয়ে রাখে না, সবার মাঝে একই সাথে আড্ডায় অংশ নেয় আর তাই চায় আবার দেশে যেতে, কাকা-মামা-মাসি-পিসি-দাদু-দিদা দের সাথে সময় কাটাতে । সুন্দর আকাশ দেখলে গায় “আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে” ……..
সাহিত্য আসরে আলোচনা করে বাংলা ভাষা কে বাঁচিয়ে রাখার রাস্তা হয়ত পাওয়া যাবে না কারণ বাস্তব জীবনধারায় তা বেশিটাই অবাস্তব । তবু প্রচেষ্টা না থাকলে হারিয়ে যাওয়া আরও সহজ ও ত্বরান্বিত হয়ে যাবে তাই কিছুটা বাঁধ দেওয়ার দরকার, কিছুটা প্রয়াসের প্রয়োজন । আর “না” বলে ধরে নিলে তো কোনো কিছুতেই কোনদিন এগোনো যাবে না, তাই এইধরনের প্রয়াস ও ইচ্ছে দেখলে ভালো লাগে যদিও সমাধানের কোনো সঠিক পথ জানা নেই তবুও ।
—- সোমা মুখোপাধ্যায়