“সিনেমার মতো”
নাটক, নির্দেশনা: ব্রাত্য বসু
প্রযোজনা: কালিন্দী ব্রাত্যজন
দুপুরে ব্রিগেডে তৃণমূলের জনসভা। বিকেলে মধুসূদন মঞ্চে “সিনেমার মতো”! এই ভাবেই আজকের দিনের অন্যতম নাট্য ব্যক্তিত্ব ব্রাত্য বসু তার রাজনৈতিক-প্রশাসনিক দায়িত্বর সঙ্গে সঙ্গে নাট্য চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি অবশ্য ব্রিগেডের পথ মাড়াই নি, মধুসূদন মঞ্চেই পৌছে গিয়েছিলাম সময়মত। ঢাকুরিয়া ক্রিকেট ক্লাবের আমন্ত্রিত শো ছিল সেদিন। প্রাথমিক কিছু বক্তৃতা, পুষ্প স্তবক, সম্মাননা জ্ঞাপন ইত্যাদি অনুষ্ঠানের পর শুরু হল নাটক।
অল্প কোথায় বলতে গেলে, “সিনেমার মতো” একটি ঝকঝকে স্মার্ট প্রযোজনা। বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের উত্থান পতনের ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে একটি পরিবার ও তার সদস্যদের ভাঙা গড়ার কাহিনী এই নাটক। নাটকের মাধ্যমে বাংলা সিনেমাকে ধরা, এবং তারই মধ্যে মানবিক সম্পর্কের টানা পোড়েনের এই মেলবন্ধন, এটা একটা নতুন ব্যাপার বটেই। আর নাট্যকার ব্রাত্য অত্যন্ত কৌশলের সঙ্গে বুনেছেন এই দুই কাহিনী। বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের এক নায়িকা (অনুসূয়া), যার গুণমুগ্ধ বর্তমান স্বামী (পীযুষ) তার স্ত্রীর জীবন নিয়ে এক ডকুমেন্টারি তৈরিতে ব্যস্ত, ছোট ছেলে স্বপ্ন দেখে নতুন যুগের সিনেমা তৈরী করার, আর মদ্যপ জ্যেষ্ঠ পুত্র তার শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি আর এক মিথ্যেকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যায়। নাটক দেখতে দেখতে অনিবার্য ভাবে মনে পড়ে যায় আর্থার মিলারের “ডেথ অফ এ সেল্স ম্যান” এর কথা – দুই ভাই, এবং তাদের পিতা – কৌলিন্যের অহংকার, আশা-প্রত্যাশা, স্বপ্ন – দুঃস্বপ্ন, অনাচার-ব্যভিচার, বিশ্বাস-বিশ্বাসহীনতা, সাফল্য-ব্যর্থতার গল্প। কিন্তু এ নাটক “ডেথ অফ এ সেল্স ম্যান” নয়, কারণ এখানে পিতা পুত্রের ব্যর্থতায় নিজেকে শেষ করেন না। এই নাটকে পুত্র পিতার ব্যর্থতার গ্লানি সহ্য করতে পারে না। তাই উইলি লোম্যানের মতই নিজেকে শেষ করে ফেলতে বাধ্য হয়। প্রধানত চরিত্রগুলির স্মৃতিচারণার মাধমেই নাট্যকার গল্প বলেন, সুতরাং এই নাটককে এক হিসেবে “মেমরি প্লে” হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। কিন্তু এই স্মৃতি চারণা যখন বাংলা সিনেমার ইতিহাস বিবৃত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন তা ক্লান্তিকর ঠেকে বৈকি। থিয়েটার দেখতে এসে দর্শক সিনেমার ইতিহাসের ক্লাসে ছাত্র হয়ে বসে থাকতে রাজি নাও হতে পারেন। এই বক্তৃতা গুলি যদি একটু সংক্ষিপ্ত করা যেত, তাহলে নাটকের সময় কিছুটা কমত, আরো আঁটসাঁট হত প্রযোজনা।
অভিনয় সকলেরই বেশ ভালো। অনুসূয়া, পীযুষ দক্ষ্য অভিনেতা এবং এই নাটকেও তার প্রমান রেখেছেন তারা। পৌলমী তার চরিত্রে যথাযত, বিশেষ কিছু তার করারও ছিল না। মুখ্য চরিত্রে ব্রাত্য বসুর অভিনয় বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য। নিজের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে এক ফাঁকে একটু মশকরাও করেছেন ব্রাত্য। মুম্বাই ফেরত বড় ভাই যখন ছোট ভাইকে বলে, “এই ভাই, তুই কি আজকাল তৃনমূল করছিস নাকি ভাই?” তখন দর্শক না হেসে পারেন না।
দৃশ্যান্তরে জনপ্রিয় বাংলা সিনেমার গানের দৃশ্যের প্রক্ষেপণ একটু ভিন্ন স্বাদ উপহার দেয় ঠিকই , কিন্তু তা মূল নাটককে কোনো ভাবে ঋদ্ধ করে বলে আমার মনে হয় না। মঞ্চ পরিকল্পনায় যথেষ্ঠ মুন্সিয়ানার পরিচয় রয়েছে। কিন্তু মধুসূদন মঞ্চের বৃহত পরিসরে, তা একটু ছোট বলেই মনে হয়েছে। প্রচুর স্পেস আসে পাশে নষ্ট হয়েছে, যা ছোট মঞ্চে হয়ত মনে হবে না।
পরিশেষে বলব, ব্রাত্য যে তার রাজনৈতিক জীবনের ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও থিয়েটার করে চলেছেন, তার জন্য তাকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন।